102-0247_img

আমার বাবার ব্যাপারে কিছু বলতে গেলেই প্রথম যেটা বলা যায়, ‘সাধারন, সিধে সাদা মানুষ।‘বাবা নামেই অন্য বন্ধু বান্ধবীদের মধ্যে একটা ভয় দেখতাম, কিন্তু আমার বাবাকে আমরা ভয় পেতাম না। কেনই বা ভয় পাবো? মা পড়া নিয়ে বকে আর বাবা? বাবা বারি ফিরলেই, ‘এই খেয়ে  ঘুমা, আর পড়তে হবেনা।‘আমাদের গ্রামে ইলেকট্রিসিটি ছিলোনা। হ্যারিকেন জ্বালিয়ে পড়তে হত।

বাবা বোধ হয় জীবনের কাছে কিছুই আশা করতো না।আমি আমার অনেক লেখায় বলেছি যে বাবা, ‘আর্থ্রাইটিসের’ পেশেন্ট ছিলো।বাবার মত চুপচাপ যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতা আমি খুব একটা দেখিনি। লোকে বলে যন্ত্রণা কি দ্যাখা যায়? আমি বলে, ‘যায়’, বাবার প্রতিটা জয়েন্ট লাল হয়ে ফুলে থাকতো, আর ওটার তাপ এবং দপদপ দ্যাখা যেতো। কিন্তু বাবা, উঃ করেও কোন ভাবে ব্যথার প্রকাশ করতো না।এই মুখবুজে যন্ত্রণা সহ্য করার একটা অদ্ভুত যুক্তি দেখাতো বাবা, ‘চিৎকার করে লোক জানালে কি যন্ত্রণা কমবে? না কেউ তার ভাগ নিতে পারবে? তাহলে উঃ! আঃ! করে লাভ?’ এই কথাটা পরবর্তী জীবনে আমার খুব কাজে লেগেছে। আমি বাবার মতন না হলেও অনেকক্ষণ দৈহিক যন্ত্রণা সহ্য করতে পারি।

103

বাবা মেয়েকে ভালোবাসবে এটাই স্বাভাবিক। আমার বাবাও তার ব্যাতিক্রম ছিলোনা।তবে বিয়ের পরে শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে যেমন মেয়ের গুন নিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ির আদিখ্যেতা দেখেছি তেমন  আমার বাবা- মা কেউ করতো না। মা তো বলতো আকাশে চাঁদ উঠলে কি লোককে বলতে হয়? সবাই জ্যোৎস্না দেখেই বোঝে।

বাবা খুব সিনেমা,  নাটক ভালোবাসতো। হিন্দি সিনেমা দেখতো।অসুস্থ বাবা বছরের পর বছর হাসপাতালে থাকতো কিন্তু সুস্থ হলেই মাছ ধরা, সিনেমা দ্যাখা থাকতোই। মা আমাদের সিনেমা দেখতে বারন করতো। বাবা বলতো, ‘যে সিনেমা যদি কাউকে ভালো বা খারাপ বানায় তাহলে তো আমাকেই সব থেকে খারাপ মানুষ বলতে হয়।’ বাবা আমাকে আর ভাই কে নিয়ে ,’সড়ক’ সিনেমা টা দেখিয়ে ছিলো।বাবা নিজে অদ্ভুত কায়দায় সিনেমা দেখতো। ম্যাটিনি শোয়ের অর্ধেক দেখে ইভনিং শোয়ের ফার্স্ট হাফ দেখে বাড়ি ফিরতো। মা বুঝতেও পারতোনা বাবা সিনেমা দেখে ফিরেছে। পরে অবশ্য বলে দিতো।

ph-10077

ঘরে থাকতেই পারতোনা। কেউ যদি বলতো তাদের পুকুরে মাছ আছে, ব্যাস বাবা ছিপ, বঁড়শি নিয়ে রেডী। অথচ ধরে আনা মাছ নিজে খেতোনা।মা বকতো, ‘জার তার বাড়ি ডাকলেই চলে জাও কেনো? তোমার কি মান সম্মান নেই?’ বাবা এমন মুখে সেই ব্যাক্তির সাথে আত্মীয়তার কথা বলতো, যে বুঝে যেতাম বলে লাভ নেই। ঠাকুমা বলতো, ‘তর দেহি হগল্ডায় আত্মীয়? পাট ক্ষেতে বিয়াইলো গাই/ হেই সূত্রে মামাতো ভাই।’ আসলেই বাবার আপন পর জ্ঞান ছিলোনা। অনেকেই ফায়দা নিতো।আমরা যখন বড় হয়েছি তখন বোঝাতাম, কিন্তু ওনার স্বভাব বদলাতো না।

রাস্তায় কতবার অচেনা মহিলা বিপদে পরেছে দেখলে ঠাকুমার কাছে নিয়ে যেতো বিয়ের পরে মায়ের কাছে। মা বলতো, ‘তুমি কোন দিন মহা বিপদে পরবে।’ বাবার সাফ যুক্তি আমি কারো খারাপ চাইনা ভগবান আমার খারাপ করতে পারবেন না।’

ph-10079

বাবার সরল বিশ্বাস ই আমাদের জীবনে সবচেয়ে ক্ষতি করলো। ২০০২ এ বাবার হার্টের অসুখ বাড়াবারি পর্জায়ে চলে গেলো। বাবাকে গান্ধী হাসপাতালে প্রায় ই এডমিট হতে হতো।আমাদের এক আত্মীয়ের পরামর্শে বাবাকে তখনকার ‘সুরক্ষা’ যা এখন,’আমরী’ নামে পরিচিত সেখানে কাকীমার ভাই ডাক্তার ভর্তি হতে বললো।প্রথম দিন ই আই সি ইউ তে নিয়ে গেলো।পরেরদিন দেখতে গেলাম, বাবা বললো, কি ব্যাবস্থা দেখেছিস?আসলে  বাবাতো কোনদিন ভালো হোটেল এও থাকেনি, কি করে বুঝবে? পরের দিন বাবার অনিচ্ছায় এঞ্জিওগ্রাফ এর মত একটা সাধারন টেষ্ট করতে গিয়েই বাবা কে ভেন্টিলেশন এ দিয়ে দিলো।প্রায় একুশ দিন রেখে বাবা, আমার মধ্যবিত্ত বাবা, জগতের কোন কূট কাচালি না জানা বাবা জীবনে প্রথমবার এক লাখ ছিয়ানব্বই হাজার টাকা দিয়ে নিজের মৃত্যু কিনে নিলো। জীবনে প্রথম এবংশেষ বার এতো খরচ করলো। দেখতে দেখতে চোদ্দটা বছর হয়ে গেলো। বাবা, তুমি যেখানেই থাকো, ভালো থেকো।এই পৃথিবীতে এলেও এবার ধনী বংশে জন্মিও, ভালো খাওয়া, ভালো থাকা জীবন পেয়ো। আর এতো ভালোমানুষ হতে যেওনা সবাই কে এতো বিশ্বাস করতে নেই এতা মনে রেখে পারলে আরেক বার জন্ম নিও।