বিয়ের আগে প্রেম বলে কিছু আসেনি স্রোতার জীবনে। কেরিয়ার ফার্ষ্ট, সবসময় এটাই মাথায় রাখতো।কিন্তু MBA শেষ হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে গেলো।বাবার হার্টের অবস্থা এতো খারাপ জেনে আর কিছু বলল না। অবশ্য বিয়ের পরেও চাইলে চাকরি করতেই পারবে, অলোকের কথায় একটু সাহস পেলো।
প্রোজেক্ট জেনারেল ম্যানেজার মিষ্টার কে. দাভে প্রচন্ড রাগী। কাজে একটু ভুল হলে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়র কে ও খুব গালি দেন।উনি মুখের সাথে সাথে হাত চালিয়ে কাজও করেন। কখনো কারো অপেক্ষায় থাকেন না। কাজ পাগল মানুষ। স্রোতা ওনাকে যত দেখে, ততই অবাক হয়,লেবারের অভাবে ডিজেলের ছোট কন্টেনার ভর্তি একটা ট্রাক ফ্যাক্টরি প্রেমিসেস এ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রথমে জিজ্ঞাসা করলেন, ট্রাক এখানে দাঁড়িয়ে কেন? কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়র,’ লেবার নেই’ বলতেই মুখ ছুটলো,’ লেবার নহি তো পিছে হাত? সাহেব হো?।‘ তারপরে নিজেই কন্টেনার নামাতে শুরু করলেন।উনি নিজেই উদাহরন। ওনার একটাই কথা, ‘যে কাজ তোমায় খেতে দিচ্ছে তাকে তুমি কোন বাহানায় অবহেলা করতে পারো না।‘ কত বয়স হবে ওনার? পঞ্চাশ তো হবেই। মাথায় কাঁচা – পাকা চুল, সটান সোজা চেহারার মানুষ। নিজে সবুজ স্কর্পিও চালিয়ে আসেন।ড্রাইভার কোম্পানী দিতে চাইলেও নেন নি। স্রোতা অদ্ভুত এক আকর্ষন বোধ করে।এমন না যে ও নিজের বর কে ভালবাসে না! তবু জীবনে প্রথমবার কেউ এতো বেশী আকর্ষন করছে। বড় দ্বিধা! স্নানঘরে আয়নার সামনে নিজেকে জিজ্ঞাসা করে, শেষে তুই ও? ডুব, ডুব! নিজের প্রতিচ্ছবিকেও বলতে পারে না।অফিসে সময়েও কখনো দাভে স্যার হেলমেট মাথায় গুজরাটের গরমে কারখানায় তদারক করছেন তো কখনো নিজেই কিছু করছেন। স্রোতা দিনে একবার একঝলক দেখার অপেক্ষায় থাকে রোজ।
এইচ আর ডিপার্টমেন্ট এ সহকারী ম্যানেজার হিসেবে আজ মাসছয়েক হল স্রোতা যোগ দিয়েছে।একদিন অফিস ছুটির একটু আগে, পিওন এসে জানালো, ‘ম্যাডাম!দাভে স্যার আপনাকে একবার ডেকেছেন। অফিসে যদি কারো ওনার কেবিনে ডাক পরে, তো তার ঘাম ছোটে। ‘যাচ্ছি !’ বলে নিজের কম্প্যিউটার শাট ডাউন করে স্রোতা ওনার কেবিনের দিকে চলতে শুরু করে। নীল বর্ডার দেওয়া দুধ সাদা অফিস বিল্ডিং। চারিদিকে বাগান। স্রোতার খুব ভাল লাগে বিকেলের দিকে অফিসের এই দিকের করিডোরে আসতে; যদিও খুব বেশী আসা হয়না।দাভে স্যার ডেকেছেন জেনেও ভয় পায়না স্রোতা।এতো সাহস কোথায় পায় জানে না, কিন্তু অন্যরা ওকে একটু অবাক হয়েই দেখে।
- মে আই কাম ইন স্যর?
- বসুন। স্রোতা নিজের কাজে কখনো ই অবহেলা করেনা, তবু এই মানুষটার সামনে বসে একটু নার্ভাস লাগে, কে জানে কোন কাজে ভুল হয়েছে কি না? ধমক টমক দেবে না তো? অবশ্য উনি ঘাড় গুঁজে যে ভাবে কাজ করছেন এই ভঙ্গি লুকিয়ে দেখতেও ভাল লাগছে।
- -কেমন লাগছে ম্যাডাম, আমাদের সাথে কাজ করতে?
- – ভালো।কেমন হালকা হাসি হাসি মুখ, চোখ। স্রোতা ভাবে এমন ভাবে বেশীক্ষন তাকালে উনি ঠিক বুঝে ফেলবেন ওর মনের কথা। তাই চোখ সরিয়ে নেয়।
একটা সিভি ওর হাতে দিয়ে বলে, ‘একজন চেনা বন্ধু রেকমেন্ড করেছে এই ছেলেটার জন্য। কাল একে ফোন করে আপনাদের সুবিধা মত ডেট দিন। দেখুন কি কাজ পারে, সেই বুঝে নিয়ে নিন। মাঝে মাঝে এইরকম আবদার সহ্য করতে হয়।‘বলে হাসলেন।
- ঠিক আছে স্যর। আরকিছু?
- -উঁ! না, এইটুকুই। আরকিছু দরকার হলে সেটা তো অফিস আওয়ার্সে পাওয়া যাবে না, ম্যাডাম!
- -থ্যাঙ্ক্যু স্যর কোনমতে বলেই স্রোতা দ্রুত নিজের কেবিনের দিকে চলে যায়। অফিসের গাড়িতেই আর ও কয়েক জনের সাথে যাতায়াত করে স্রোতা। অন্যদিন হাসি গল্প করে কিন্তু আজকে ও বারবার আনমনা হয়ে যায়, কি বললেন উনি? আরকিছু দরকার থাকলেও অফিসের সময় পাওয়া যাবে না?উনি ঠিক বুঝতে পেরেছেন। এবার কি হবে?নানান সম্ভাবনায় ওর গাল লাল এবং গরম হতে থাকে।
- বাঙালী মেয়ে হিসেবে স্রোতা খানিক টা লম্বা। এই পাঁচ চার বা পাঁচ পাঁচ মত । গমের মত গায়ের রঙ।কথাবলা চোখ আর লম্বা চুল, মেদহীন শরীর নিয়ে যথেষ্ট আকর্ষনীয়া। জীবনে সে ভাবে ছেলেদের সাথে মেশা হয়নি। সব মনোযোগ কেরিয়ারেই ফোকাস করা ছিল।বিয়ে হওয়ায় অলোক ই প্রথম পুরুষ। শরীর যে কোন মানুষের কথা ভাবলে জাগতে পারে, বা প্রেম যে এতো সুন্দর অনুভূতি তা এই মানুষটাকে না দেখলে অজানাই থেকে যেতো। এটা কি একতরফা? উনিতো স্রোতার থেকে দ্বিগুন বয়সী। এম৹ডির বোনের বর। সব জেনেও কেন, কেন এমন ভাবে টান তৈরী হচ্ছে?
- কয়েকমাস পরের এক দিন। পরের দু দিন অফিস ছুটি থাকবে তাই স্রোতা হাতের সব কাজ শেষ করছিলো।বেশ কিছু কাজ শেষ করতে করতে ছ’টার বেশী ই হয়ে যাওয়ায় স্রোতা একাই হাঁটছিল বাস ষ্ট্যান্ডের দিকে।ফুটপাথ দিয়ে নিজের মনে হাঁটতে হাঁটতে হঠাত ওর পাশ ঘেঁসে গাড়ি যেতেই চমকে যায়। দেখে দাভে স্যারের গাড়ি। কিছুটা গিয়েই থেমেছে। গাড়ীর জানলায় সেই দিনের মত চোখে হাসি নিয়ে স্বয়ং উনি।‘ দেরী হয়েছে? আসুন আমি ছেড়ে দিচ্ছি।‘
- না!না আমি বাসে চলে যাবো।
- -আমি তো বলিনি যেতে পারবেন না? আসুন বলে দরজা খুলে দিলেন, ওনার পাশে বসে যেতে হবে? স্রোতা বুঝতে পারে না তার খুশি হওয়া উচিত না ভয়?
- – কোথায় থাকেন?
- -এই তো সেক্টর ফাইভ এ।
- -হুম
- -আপনার বাড়ীতে আর কে কে থাকে?
- আমি আর আমার বর।
- -ও! নতুন বিয়ে?
- – হুম
- – লভ ম্যারেজ না কি এ্যারেঞ্জড?’বাবা-মায়ের ঠিক করা।‘সারু ছে।‘’ দেখুন ম্যাডাম, অফিসের বাইরে না কেউ বস না কর্মচারী।আপনিও কি আমায় ভয় পান?
- -হ্যাঁ! আপকা গুসসা, কুছ জ্যাদা।
- হা হা হা হা
- -আরে ধুর।ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আপনি বাঙালী; রয়্যাল বেঙল টাইগার এর আত্মীয়।
- এবার স্রোতাও হেসে ফেলে।‘আর আপনি বুঝি গিরের সিংহ?’
- -এই তো। হ্যাঁ! সিংহ ই বটে।
- বাড়ীর কাছে আসতেই স্রোতা বলে,’স্যর, এক কাপ চা খেয়ে যান।‘
- ‘ফির কভি’ বলেই উনি গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেলেন।
- সেদিন রাতে এক অজানা নম্বর থেকে মেসেজ এলো, ‘বিজি?’
- – কার নম্বর মিনিটে বুঝে যায় স্রোতা। তবু জিজ্ঞাসা করে , ‘আপনি কে?’
- আমি গির এর সিংহ, রয়াল বেঙল টাইগ্রেস ম্যাডাম।
- কথার পৃষ্ঠে কথা চলতেই থাকে। অমন গুরু গম্ভীর মানুষের আড়ালে এক দুষ্টু কিশোর লুকিয়ে ছিলো!স্রোতা ভেসে যায়, ডুবে যায়।
- রোজ অফিসে দেখা হয়, চোখের গভীরে দুজন ই ডোবে। স্রোতা দেখে কর্পোরেট ক্ল্যাশ। একদিন বলেই দিলো,’রাগ একটু কম করলে হয়না?’ তত দিনে উনি তুই করেই বলেন, অবশ্য ই অফিসের বাইরে। ‘তুই ও ভয় পাচ্ছিস নাকি?’ ভয়? একধরনের ভয় ই বটে। যদি কেউ ক্ষতি করে দেয়?
- একদিন স্রোতার খুব মাথায় যন্ত্রণা। মাইগ্রেন এ ভোগে ও।
- এগারোটা নাগাদ ফোন, ‘কি হয়েছে? আসিস নি কেন?’
- ‘মাইগ্রেনের যন্ত্রণা।‘
এক ঘন্টা পরেই দরজায় বেল বাজে।দরজা খুলে ভুত দেখার মত চমকায় স্রোতা।
‘আপনি? এখন?’
সেদিন হালকা সবুজ একটা কুর্তা আর কমলা কেপ্রি পরেছিল। উনি কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই জড়িয়ে ধরে গভীর এক চুমু খেতে থাকেন। ঠোঁট, জিভদিয়ে চুষে নেন স্রোতার যন্ত্রনা।প্রেমের গভীরতা মাপা যায় চুমুর মধ্যেই।
- কতক্ষন ছিলো ওনার দু হাতের বাঁধনে? জানে না।সময় থমকে গিয়েছিল।
- ‘আমার বর কে ঠকানো হচ্ছে না?’স্রোতার প্রশ্নের উত্তরে উনি একটাই কথা বলেন,
- – ‘জানিনা। আমরা দু জনেই বিবাহিত, আমার তো দুটো মেয়েও আছে। কিন্তু কি করবো? তোকে যেদিন প্রথম দেখেছি, সেদিন থেকেই আমার বুকে ঝড় চলছে।তুই অনেক ছোট, তবু বিশ্বাস কর, তোর আগে আমি প্রেম কি জানতাম না। যখন যেখানে অফিস ট্যুরে গেছি,এসকর্ট সার্ভিস নিয়েছি। সে ছিলো আমার শরীরের চাহিদা। যবে থেকে তোর প্রেম এ পরেছি, সব কিছু ভুলে গেছি। কিছুদিন আগে, এই তুই অফিসে ঢোকার পর আমি ইটালী গিয়েছিলাম, কিন্তু কোন কিছুর চাহিদা বোধ করিনি। খালি তোর চোখ দুটো মনে পরতো। এটা যদি পাপ হয় তো এমন পাপ আমি যত বার জন্মাবো তত বার করতে চাইবো।‘
- দিন কাটতে থাকে। এমন সময় অলোকের ট্রান্সফার হয় লন্ডন ব্রাঞ্চে। স্রোতা কেও যেতে হবে। ও অফিসে একমাসের নোটিশ দেয়।দেখা করেনা স্রোতা।ফোনেও দু’একটা কথার পরেই গলা বন্ধ হয়ে আসে কান্নায়। ও দেখাতে চায়না বুকের অবিরাম রক্তাক্ত হওয়া। অফিস থেকে ফেয়ারওয়েল দেওয়া হয়। মানা করেছিলো স্রোতা, কিন্তু কেউ শুনলে তবে না?অনেক উপহারের মাঝে সবার অলক্ষ্যে একটা ছোট্ট কার্ড পায় যাতে লেখা, “আমার আদরের ছোট্ট রয়্যাল বেঙ্গল টাইগ্রেস কে, অনেক আদর আর শুভেচ্ছা।“ –‘গিরের সিংহ।‘
- দু বছর কেটে যায়। লন্ডনে স্রোতা আর অলোকের একটা মেয়ে জন্মায়, যাকে একান্তে স্রোতা ডাকে,’গিরের সিংহ’ বলে।